-->

বেলা ফুরাবার আগে - চোখের রোগ (পর্ব - ৬)

বেলা ফুরাবার আগে আরিফ আজাদ, বেলা ফুরাবার আগে online reading, আরিফ আজাদের বই,চোখের রোগ, জীবনের ইঁদুর দৌড় কাহিনি, বলো সুখ কোথা পাই,বেলা ফুরাবার আগে pdf
[ক]

এক বন্ধুর সাথে একবার ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে গিয়েছিলাম। আমার চোখে গােলগাল একটা যন্ত্র পরিয়ে দিয়ে ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘সামনে তাকান।

আমি সামনের দিকে তাকালাম। তিনি বললেন, ‘কী দেখতে পাচ্ছেন?

‘কিছু ইংরেজি বর্ণ।

পড়ুন সেগুলাে।

আমার সামনে একটা গােলাকার চক-প্লেটে পেন্ডুলামের মতাে ঝুলতে থাকা ইংরেজি বর্ণগুলাের কোনােটা খুবই ক্ষুদ্র আকৃতির, আবার কোনােটা খুব বড়। ছােট-বড় আর মাঝারি আকৃতির এই বর্ণমালা পড়তে বেশ অসুবিধা হবার কথা। চোখে সমস্যা থাকলে তাে বেশ বিপাকেই পড়তে হবে। মূলত চোখে কোনাে সমস্যা আছে কি না তা নির্ণয়ের জন্যই এগুলােকে এভাবে সাজানাে হয়েছে। কিন্তু বর্ণমালা পড়তে আমার কোনাে অসুবিধেই হয়নি। গড়গড় করে এক নিঃশ্বাসে সেগুলাে পড়ে ফেললাম। পাশে বসে থাকা ভদ্রলােক গােলগাল যন্ত্রটা আমার চোখ থেকে খুলে নিয়ে বললেন-

‘আপনি তাে চোখে আমার চেয়েও ভালাে দেখতে পান। কী জন্যে এসেছেন?

‘রুটিন চেক-আপ করাতে।

রেগুলার করান?'

না ।’

তাহলে?

‘এই যে, আজ থেকে শুরু করলাম।

আমার কথা শুনে ভদ্রলােক ফিক করে হেসে দিলেন।

[খ]

ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের অত্যাধুনিক যন্ত্র আমার চোখে কোনাে সমস্যা খুঁজে পায়নি। চোখের চিকিৎসার ওপর বড়সড় রকমের ডিগ্রীধারী ডাক্তারও আমার চোখ দেখে বললেন যে, আমার চোখ দিব্যি সুস্থ। বিজ্ঞানের অত্যাধুনিক যন্ত্র আর ডিগ্রীপ্রাপ্ত ডাক্তারেরা আমার চোখে সমস্যা খুঁজে না পেলেও আমি তাে জানি আমার চোখ কী পরিমাণ অসুস্থ। আমার চোখে রয়েছে এক অদ্ভুত রকমের অসুখ! সেই অসুখ শনাক্ত করার ক্ষমতা এখানকার যন্ত্রগুলাের নেই। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান কিংবা ভালাে পাওয়ারের চশমাও কখনাে সেই অসুখ সারাতে পারবে না। দুনিয়ার কোনাে অত্যাধুনিক যন্ত্রও এই অসুখ খুজে পাবে না, কারণ, এই অসুখের কেন্দ্রস্থল চোখের কর্নিয়া নয়, বক্ষথিত অন্তর।

চোখে দেখতে না পাওয়াটা—একটা সমস্যা বটে, তবে খুব গুরুতর সমস্যা নয়। জগতে প্রতারণার সবচেয়ে বিশ্বস্ত অঙ্গাই সম্ভবত চোখ। চোখে দিব্যি দেখতে পায়—এমন কত লােকই তাে অন্য লােককে চোখে চোখ রেখে খুন করে ফেলে। চোখে দেখতে পাওয়া লােকগুলাে কত সহজেই চোখে চোখ রেখে মিথ্যে কথা বলে, চোখের দৃষ্টি দিয়ে সুদ আর ঘুসের টাকা গুনে গুনে পকেট ভরতি করে। তারা মনে করে তাদের চোখগুলাে দিব্যি ভালাে আছে। কেবল চোখে দেখতে পাওয়াই কি সত্যিকার চোখের সুস্থতা?

উম্মু মাকতুম রাযিয়াল্লাহু আনহু। অন্ধ সাহাবি। চর্মচক্ষু দিয়ে দুনিয়াকে দেখার সুবিধে থেকে তিনি ছিলেন বঞ্চিত। তবে, তিনি কি সত্যিই অন্ধ ছিলেন? সত্যিই কি তিনি চোখে দেখতে পেতেন না? যদি না-ই দেখতে পান, হেরা গুহা থেকে উৎসারিত সেই শুদ্ধতম আলাের খোঁজ তিনি পেলেন কীভাবে? কীভাবে ঠিক ঠিক চিনে ফেলেছিলেন আসমান ভেদ করে আসা সেই সত্যটিকে? দুনিয়াকে আলােকিত করতে আসা অতিজাগতিক সেই আলােকে তিনি চিনতে পারলেন কী উপায়ে? তবে কি অন্ধত্ব মানেই না দেখা’ নয়? তবে কি মানুষ চোখ ছাড়াও অন্য কোনাে উপায়ে, অন্য কোনাে মাধ্যমে দেখতে পায়? তাহলে কোন সে উপায়? কোন সে মাধ্যম?

হ্যাঁ, সেই মাধ্যম হলাে অন্তরের চোখ। বক্ষঙ্খিত যে চোখ, সেই চোখ যদি সুস্থ থাকে, তার জন্য দুনিয়া কখনাে অন্ধকার হয় না। সুস্থ চর্মচক্ষু যেখানে ঘাের অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখে না, অন্তর্চক্ষু সেখানে দেখতে পায় ঝলমলে আলাে। সাহাবি উম্ম মাকতুম রাযিয়াল্লাহু আনহুর চর্মচক্ষুতে আলাে ছিল না, তবে তার বক্ষস্থিত চোখের জ্যোতি তাকে সত্যিকার অন্ধ হতে দেয়নি। সেই জ্যোতি ঠিক ঠিক খুঁজে নিয়েছিল শুদ্ধতার পথ। খুঁজে নিয়েছিল পরম পবিত্র সত্যটিকে। সেই সত্যের নাম তাওহিদ। একত্ববাদ। এক ইলাহ। এক মাবুদ।

পক্ষান্তরে, আবু জাহেল কিংবা আবু লাহাবের কথা চিন্তা করুন। বাহ্যিক চোখে দুনিয়ার সবকিছু তারা দেখতে পেলেও তাদের অন্তরের চোখ ছিল মৃত। তাদের চর্মচক্ষু ছিল দিব্যি সুস্থ। কিন্তু বক্ষঙ্খিত যে চোখ, সেই চোখ ছিল আলােকহীন। বাহ্যিক চোখে দুনিয়ার সবকিছু দেখার সাধ মিটলেও তারা দেখতে পায়নি আসমানি আলাের প্রভা। যে আলাের ঝিলিক রাঙিয়ে দিয়ে গেছে পৃথিবীর পথপ্রান্তর, যে আলােতে ঝলমল করে উঠেছিল মরু-মূষিকের উপত্যকা, সেই আলাের বাণী পৌঁছতে পারেনি তাদের অন্তরের কুঠুরিতে। তাদের অন্তৰ্চোখ ছিল মৃত। অন্তরের চোখ মরে যাওয়াতে তারা সত্যটাকে চিনতে পারেনি। খুঁজে আনতে পারেনি দিগন্তবিস্তৃত সেই ঐশী আলাের রেখা। বাহ্যিক দৃষ্টি আর অন্তদৃষ্টির মধ্যে কি আকাশপাতাল ব্যবধান, তাই না?

[গ]

ক্যাম্পাসে সুন্দরী মেয়ে দেখলেই বলি, দোস্ত, আমি না অমুকের ওপর ক্রাশ খেয়েছি। ক্রাশ খাওয়া মানে মেয়েটার রূপ দেখে পাগল হয়ে যাওয়া। কল্পনায় নীল শাড়ি পরিহিত সেই ললনার খোঁপায় গােলাপ গুঁজে দিতে দিতে বলা, তােমার জন্য দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বাঁধতে পারি লাল কাপড়। বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে আনতে পারি একশ আটটি নীলপদ্ম। কল্পনায় আমি হয়ে যাই শাহজাহান আর সে হয় আমার মমতাজ। আমার রাতগুলাে কেটে যায় সেই ক্রাশের কথা ভাবতে ভাবতে। দিনগুলােতে আমার মন খালি আনচান করে তাকে এক নজর দেখার জন্য। আমার চোখে সে-ই হলাে মােনালিসা। রূপকথার রূপের দেবী আফ্রোদিতি। তাকে দেখলেই আমার মনের ভেতর উথালপাথাল শুরু হয়। আমি তখন কবি হয়ে যাই। আনমনে গুনগুন করি, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মাের অপরাধ?

নিজেকে কবি বানানাের আগে, আমরা কি একবার আল-কুরআনের দিকে ফিরে যেতে পারি না? আমরা তাে বিশ্বাস করি, আল-কুরআন হলাে আমাদের জীবনবিধান। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা স্পষ্ট করেই বলছেন—

قل للمؤمنين يغضوا من أبصارهم

(হে রাসুল) মুমিন পুরুষদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে।১] আমাকে জানতে হবে, কোনাে বেগানা নারীর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকার অনুমতি আমাকে দেওয়া হয়নি। বরং, হাদিসে বলা হয়েছে, কোনাে নারীর দিকে দৃষ্টি চলে গেলে সাথে সাথে তা ফিরিয়ে নিতে। ভুলেও দ্বিতীয় বার যেন মুখ তুলে না তাকানাে হয়।[২] কারণ, দ্বিতীয় বারের তাকানােতে শয়তানের কুমন্ত্রণা থাকে। শয়তান তখন মনের ভেতরে কুমন্ত্রণা দেয় আর করিয়ে নেয় বিভিন্ন ধরনের পাপকাজ। একটি সহিহ হাদিস থেকে জানা যায়, একবার মুযদালিফাহ থেকে মিনায় যাত্রাকালে আল ফাদল ইবনু আব্বাস এক মহিলার দিকে বারংবার তাকাচ্ছিলেন। এটা দেখে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে তার ঘাড়টাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন।[৩]

সুরা আল মুমিনের ১৯ নম্বর আয়াত : যেখানে বলা হচ্ছে, ‘চক্ষুসমূহের খিয়ানত এবং অন্তরসমূহ যা গােপন রাখে তা তিনি জানেন’–এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আয়াতটিতে এমন এক ব্যক্তির কথা বলা হচ্ছে, যে কোনাে বাড়িতে যায় এবং ওই বাড়ির সুন্দরী মহিলার দিকে বারংবার চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকায়। যখনই তার এই কাজ কারও নজরে পড়ে যায়, তখন সে চোখ নামিয়ে ফেলে। এরপর, আবার যখন সে সুযােগ পায়, তখন আবার ওই সুন্দরী মহিলার দিকে তাকায়।[8]

খেয়াল করুন, এই যে একজন মহিলার দিকে বারবার নজর দেওয়া, ফিরে ফিরে তাকানাে, এটাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ‘চোখের খিয়ানত বলেছেন।

61 

‘খিয়ানত মানে হলাে আপনার কাছে কেউ কিছু গচ্ছিত রেখেছে, কিন্তু সেই জিনিসটা আপনি হয় অপব্যবহার করেছেন, নয়তাে আত্মসাৎ করেছেন। চোখ হলাে আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া অন্যতম আমানত। সেই আমানত দিয়ে যখন আমরা ভুল কিছু দেখব, তখন তা খিয়ানত নয় তাে কী?

কোনাে মহিলার দিকে লুকিয়ে-চুরিয়ে তাকানােটাও আল্লাহর কাছে যদি গােপন না থাকে, তাহলে আমরা যারা নিত্যনতুন ‘ক্রাশ খেয়ে ভাবনার সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে পাপের জলে অবগাহন করি, আমাদের ক্ষেত্রে কী হবে? আমরা যেটাকে ‘ক্রাশ’ বলছি, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেটাকে চোখের যিনা বলেছেন [১]

[ঘ]

তাহলে উপায়? অন্তদৃষ্টিতে যে বিশাল রােগ নিয়ে আমার বসবাস, সেই রােগ সারাবার পথ্য কী? মনের ভেতরে শেকড় গেড়ে বসা লালসার পাহাড়, শয়তানের ধোঁকায় পড়ে কলুষিত করে রাখা অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার প্রেসক্রিপশান কী? প্রেসক্রিপশান হলাে তাকওয়া। আল্লাহভীতি। আল্লাহকে ভয় করা। মনের ভেতরে সুরা যিলযালে বলা আল্লাহর এই কথাগুলাে গেঁথে নেওয়া—

فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ ✡ وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ

অতএব, কেউ অণু পরিমাণ ভালাে কাজ করলে তা সে (বিচার দিবসে) দেখতে পাবে। আবার কেউ অণু পরিমাণ খারাপ কাজ করলে তাও সে দেখতে পাবে[২]

আমি আজ যে মেয়েটির ওপর ক্রাশ খাচ্ছি, যে মহিলাকে নিয়ে আমি আজ মৌজ-মাস্তি করছি, তা আমার আমলনামায় উঠে যাচ্ছে। মােবাইল আর কম্পিউটারের বদৌলতে যে নীল দুনিয়ায় আমি বিচরণ করছি, সেই বিচরণের প্রতিটি মুহূর্ত লিপিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে একটি অদৃশ্য আমলনামায়। ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের অত্যাধুনিক যন্ত্রে হয়তাে এই রােগ আর এই হিশেব ধরা পড়বে না, কিন্তু পুনরুত্থান দিবসে আমার সামনে আমার সকল কৃতকর্মকে উপস্থাপন করা হবে। ব্রাউজার হিস্ট্রি থেকে এক ক্লিকে মুছে দেওয়া নিষিদ্ধ সাইটের বিচরণ থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের সেই কাশের কথা ভাবতে ভাবতে জড়িয়ে পড়া পাপ—সবকিছুই আমার সামনে হাজির করা হবে। এই রােগ থেকে বাঁচার একটাই উপায়—তাওবা। করজোড়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করা। এ রকম পাপে আর না জড়ানাের দৃঢ় শপথ করা। সর্বোপরি, ফরয সালাত এবং তাহাজ্জুদের সালাতে আল্লাহর কাছে অশ্রু বিসর্জনের মাধ্যমে হিদায়াত চাওয়া। যে মহান রব আমাকে চোখের মতন নিআমত দ্বারা ধন্য করেছেন, তার দরবারে আকুল ফরিয়াদে নত হওয়া।