-->

বেলা ফুরাবার আগে - আমার এত দুঃখ কেন ? (পর্ব - ৩)

বেলা ফুরাবার আগে আরিফ আজাদ, বেলা ফুরাবার আগে online reading, আরিফ আজাদের বই, জীবন যেখানে যেমন, এবার ভিন্ন কিছু হোক, বেলা ফুরাবার আগে Pdf, আরিফ আজাদ
[ ক ]

মাঝে মাঝে ভীষণ কষ্ট লাগে। বুকের ভেতরে বাসা বাঁধে দুঃখের কালাে মেঘ। অবিরাম বৃষ্টিধারার মতাে বিষন্নতা এসে আছড়ে পড়ে মনের উঠোনে। আকাশছোঁয়া হিমালয় যেন তার সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে ভেঙে পড়তে চায় বুকের ওপর। জগৎসংসার তখন বিষাক্ত লাগে।

মাঝে মাঝে প্রচণ্ড দুঃখবােধে ভেঙে পড়ি আমরা। হয়তাে হঠাৎ করে হারিয়ে বসি কোনাে প্রিয় মানুষকে। খুব আশা করে থাকি এবারের পৌষের শীতে মায়ের হাতে বানানাে ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা খাব বলে। কিন্তু পৌষ আসার আগেই মা হয়তাে দুনিয়ার পাঠ চুকিয়ে ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন। অথবা, আস্তে আস্তে করে জমানাে টাকা, যে টাকা দিয়ে বাবাকে ঈদে উপহার দিয়ে চমকে দেবাে ভেবেছিলাম, ঈদ আসার আগেই হয়তাে বাবা চলে গেছেন রবের সাক্ষাতে।

এমনও হতে পারে, ভালাে বেতনের কোনাে চাকরি হঠাৎ করেই চলে গেল। অথবা, আমার এক বন্ধু আমার সমান যােগ্যতা নিয়ে জীবনে সাঁই সাঁই করে উন্নতি করছে, কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছি না। আমার বন্ধু আমার সমান খাটা-খাটুনি করে খুব ভালাে রেজাল্ট করছে, কিন্তু আমি পারছি না।

পারিবারিক অথবা দাম্পত্য জীবনটাও খুব একটা ভালাে যাচ্ছে না। ব্যবসায় লােকসান হচ্ছে। খেতে নষ্ট হচ্ছে ফসল। উর্বরতা হারাচ্ছে আবাদি জমি। মরে যাচ্ছে গবাদি পশু। বন্যায় ভেসে গেছে একমাত্র আশ্রয়। অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তিলে তিলে জমানাে সম্পদ। মাথার ওপর বেড়েই চলেছে ঋণের বােঝা। আবার, এমনও হতে পারে, কাছের মানুষগুলাে আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটিও আজ আর ফিরে তাকাচ্ছে না। বাড়ছে দূরত্ব। ভেঙে যাচ্ছে সম্পর্কের বন্ধন এমন নানান রকম জীবন সমস্যার মুখােমুখি কমবেশি আমরা সকলেই হয়ে থাকি। আমরা ভেঙে পড়ি। ভেতরে ভেতরে খুঁড়িয়ে যাই। আশাহত হই। বিষন্নতার বিষবাষ্পে ছেয়ে যায় আমাদের হৃদয়কোণ। কিন্তু আমাদের সাথে কেন এমনটা হয়?

[খ]

আমরা সকলেই ‘‘পরীক্ষা’ শব্দটির সাথে পরিচিত। স্কুল, কলেজ ইউনিভার্সিটিগুলােতে আমরা পরীক্ষা দিই। পরীক্ষায় পাশের জন্য আমরা দিনরাত পড়াশুনা করি। নােট করি। নিয়মিত ক্লাস করি। দুনিয়ার জীবনটাও আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য ঠিক সে রকম একটা পরীক্ষা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের এই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন পরীক্ষা করার জন্যই। আমরা তাঁর অনুগত বান্দা কি না তা যাচাইয়ের জন্য। নাহ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা অবশ্যই এই যাচাই-বাছাইয়ের ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল নন। তিনি আলিমুল গায়েব। ভূত-ভবিষ্যৎ সবকিছুই তিনি জানেন। তিনি জানেন আমাদের মধ্যে কে কে তাঁর অনুগত আর কে কে তাঁর অবাধ্য। চাইলেই তিনি আমাদের দুনিয়াতে না পাঠিয়ে সরাসরি আমাদের রূহ তথা আত্মাগুলােকে হয় জান্নাতে আর না হয় জাহান্নামে দিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি এমনটি করেননি। কারণ, তিনি আমাদের কোনাে প্রশ্ন করার সুযােগ দিতে চাননি। কী রকম প্রশ্ন? কিয়ামতের মাঠে যাতে আমরা অভিযােগ করে বলতে না পারি, ‘আপনি আমাদের তাে পরীক্ষাই করেননি। পরীক্ষা ছাড়াই আমাদের জাহান্নামে পাঠিয়েছেন। অথচ আমার পরীক্ষা নিলে আজকে আমি জাহান্নামের বদলে জান্নাতে থাকতে পারতাম!

দুনিয়াকে আল্লাহ তাআলা বানিয়েছেন বিশাল একটা পরীক্ষাকেন্দ্র। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআনে বলছেন-

عَسَى أَن تُحِبُّواْ شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ وَاللّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ

আমি অবশ্যই তােমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা এবং তােমাদের) জানমাল ও ফসলাদির ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে। আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন [1]

[1]সুরা বাকারা, আয়াত : ১৫৫

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের পরীক্ষা করবেন ভয়ভীতি দিয়ে। কখনাে কি এমন হয়েছে যে, আপনি বাসে করে কোথাও যাচ্ছেন এবং সেই বাসটা হঠাৎ করে দুর্ঘটনার কবলে পড়ল? সেই দুর্ঘটনায় মারা গেছে আপনার পাশের যাত্রীটা, কিন্তু আপনার তেমন কোনাে ক্ষতিই হয়নি। হয়েছে এ রকম?

দূরের যাত্রার বিরক্তি কাটাতে একটু আগেও দুজনে পাশাপাশি দিব্যি খােশগল্প করছিলেন। কিন্তু কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই আপনার পাশের সেই সহযাত্রী এখন মৃত আর আপনি জীবিত রয়ে গেলেন। এই দুর্ঘটনায় কিন্তু আপনারও মৃত্যু হতে পারত। পাশের সহযাত্রীর মতাে আপনিও কিন্তু লাশে পরিণত হতে পারতেন। আপনার নামের পাশে ‘আহত' শব্দের বদলে শােভা পেত নিহত’ শব্দটি। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আপনাকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন। চাক্ষুষ এই ভয়ানক দৃশ্য অবলােকন করিয়ে আল্লাহ আপনাকে পরীক্ষা করেন। তিনি দেখতে চান যে, আপনি এই দৃশ্য থেকে শিক্ষা নেন কি না। তাঁর শােকর আদায় করেন কি না। তার অবাধ্যতা থেকে ফিরে আসেন কি না। তিনি দেখতে চান, এই মৃত্যুর দৃশ্যটা আপনার হৃদয়ে কতটা প্রভাব ফেলে। আপনার বােধােদয় ঘটে কি না। এ রকম বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখে আপনি মৃত্যুভয়ে কাতর হয়ে পড়েন কি না—সেটাই হলাে আপনার জন্য পরীক্ষা।

জীবনে এমন আরও বহু ঘটনার সাক্ষী আপনি হতে পারেন। লন্ডনে যাওয়ার জন্য আপনি বুধবার সকালের বিমানের টিকেট চেয়েছেন, কিন্তু পেয়েছেন বুধবার বিকেলের। সকালের টিকেট না পাওয়ায় আপনার প্রচণ্ড মন খারাপ হতে পারে সকালের টিকেট না পাওয়ায় লন্ডনে কোনাে একটা পার্টিতে আপনি অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। হতে পারে ম্যানচেস্টার শহরের কোনাে এক মনােজ্ঞ অনুষ্ঠান আপনি মিস করবেন। অস্বাভাবিক নয়।

কিন্তু সকালের টিকেট না পাওয়াতে একরাশ দুঃখ আর মন খারাপ নিয়ে টিভি খুলে যখন দেখতে পেলেন লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা সকালের নির্ধারিত সেই ফ্লাইট ক্র্যাশ করেছে এবং নিহত হয়েছে বিমানের সকল যাত্রী, তখন কেমন লাগবে আপনার বলুন তাে? মিস হয়ে যাওয়া ম্যানচেস্টারের ওই মনােজ্ঞ অনুষ্ঠান কি আপনার প্রাণের চেয়েও মূল্যবান? সকালের ফ্লাইট মিস হয়ে যাওয়ায় আপনার কি তখনাে মন খারাপ থাকবে? আফসােস হবে?

মানুষের একটা বৈশিষ্ট্য হলাে সে নিজেকে সবসময় নির্ভুলতার আসনে দেখতে পছন্দ করে। সে মনে করে তার জীবনের সব ভালােমন্দ, ঠিক-বেঠিক বােঝার ব্যাপারে সে-ই যথেষ্ট। নিজের জন্য পছন্দ করা জিনিসটা কীভাবে তার জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে সেটা মানুষ ভাবতেও পারে না। আবার, এটাও মানুষ কল্পনা করতে পারে না যে, যেটা সে অপছন্দ করে, সেটা কীভাবে তার জন্য জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠতে পারে। মানুষ এটা কখনােই বুঝতে পারবে না। এটা জানেন কেবল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা। কারণ, তিনিই অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের ব্যাপারে জ্ঞান রাখেন। এজন্যেই তিনি বলেছেন-

عسى أن تكرهوا شيئا وهو خير له وعسى أن تحبوا شيئا وهو شر لكم والله يعلم وأنتم لا تعلمون

হয়তাে তােমরা যা অপছন্দ করাে তা-ই তােমাদের জন্য কল্যাণকর আর তােমরা যা পছন্দ করাে, সেটা হতে পারে অকল্যাণকর। বস্তুত আল্লাহ জানেন। কিন্তু তােমরা জানাে না।[1]

সুরা বাকারা, আয়াত : ২১৬

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা দেখতে চান, এ রকম নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে আপনাকে বাঁচানাের পরেও আপনি পরের বার ম্যানচেস্টার শহরের মদের বারে যান কি । তিনি দেখতে চান, রাত হলেই আপনি তার অবাধ্যতায় গা ভাসিয়ে কোনাে নাইট ক্লাবে গিয়ে ফুর্তিতে মেতে ওঠেন কি না। এই যে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে আপনার মধ্যে একটা ভয় ধরিয়ে দেওয়া, সেটাই আল্লাহর পরীক্ষা। তিনি দেখতে চান এই ভয় আপনাকে কোন দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহর পথে না শয়তানের রাস্তায়?

আল্লাহ তাআলা পরীক্ষা করবেন ক্ষুধা-অনাহারের মাধ্যমে। এই উদাহরণের যথার্থতা উপলব্ধি করার জন্য রাস্তার একজন ভিক্ষুকের দিকে তাকান। অথবা সেই অভাবী লােকটার দিকে যে অপলক দৃষ্টিতে আপনার বার্গার খাওয়ার দৃশ্যটি অবলােকন করে। খুব বেশি দূরেও যেতে হবে না—মায়ানমার থেকে আসা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের কথা ভাবুন তাে। কতটা মানবেতর তাদের জীবন! তাদের ওপর এই যে অত্যাচার, এই যে ক্ষুধার যন্ত্রণা, হতে পারে এটা তাদের জন্য পরীক্ষা।

বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়াটা একজন কৃষকের জন্য পরীক্ষা হতে পারে। আগুন লেগে ফ্যাক্টরি পুড়ে যাওয়াটা একজন ব্যবসায়ীর জন্য পরীক্ষা হতে পারে। মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান কিংবা কাছের কেউ মারা যাওয়া-সহ নানানভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের পরীক্ষা করতে পারেন। রােগ-শােক, জরা-ক্লিষ্টতা ইত্যাদি হতে পারে আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য পরীক্ষাস্বরূপ।

[গ]

ছােটবেলায় হাটে গেলে ঢু মেরে আসতাম কামারের দোকানে। দেখতাম লােহাকে কীভাবে কড়া আগুনে পুড়িয়ে পিটানাে হতাে। ভয় পেতাম। মনে হতাে, এই লােহাগুলােকে যে এভাবে পােড়াচ্ছে, এগুলাে তাে ছাই হয়ে যাবে। আস্তে আস্তে বুঝলাম যে লােহাকে এভাবে পােড়ালে আসলে ছাই হয় না; বরং লােহা আরও মজবুত এবং ব্যবহার উপযােগী হয়ে ওঠে। আগুনের ‘পােড়ানাে ধর্ম আর লােহার বস্তু ধর্ম মাথায় নিয়ে আগুন এবং লােহার মধ্যকার এই যােগসূত্র বুঝতে আমার অনেক দিন লেগেছিল।

‘পরীক্ষা’ হিশেবে জীবনের এই যে নানামুখী সমস্যা ও সংকট, এগুলাে হলাে আগুনের মতাে। আর বান্দাকে তুলনা করা যায় লােহার সাথে। আগুন আর লােহার সম্পর্ক যেমন পুড়িয়ে নিঃশেষ বা ধ্বংস করে ফেলা নয়, বরং সুন্দর ও উপকারী কিছু তৈরি করা, আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা এই পরীক্ষাগুলােও বান্দার জন্য খারাপ কিছু নয়, বরঞ বান্দাকে পরিশুদ্ধ করে তােলাই আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদেরই বেশি পরীক্ষা করেন। আল্লাহ যদি চান যে তাঁর কোনাে বান্দা শুদ্ধ আর শুভ্রতার স্পর্শে পবিত্র হয়ে উঠুক, তখন তিনি সেই বান্দার বেশি বেশি পরীক্ষা নেন।

নবি-রাসুলদের জীবনের দিকে তাকালেই আমরা এর সত্যতা দেখতে পাই। সম্ভবত আল্লাহ তাআলা এমন কোনাে নবি-রাসুল দুনিয়ায় প্রেরণ করেননি, যাকে কঠিন পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয়নি। শিশু মুসা আলাইহিস সালামকে তাে শত্রুর ভয়ে বাক্সে ভরে দরিয়ায় নিক্ষেপ করতে হয়েছিল। বড় হয়ে ওঠার পরেও কি তাকে কম পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে? ফিরাউনের মুখােমুখি হওয়া থেকে শুরু করে গভীর সংকট মাথায় নিয়ে লােহিত সাগর পার হওয়া। আহ! কতই-না সংকটাপন্ন মুহূর্ত ছিল সেগুলাে!

নবি আইয়ুব আলাইহিস সালাম। শেষ বয়সে এসে আল্লাহর পরীক্ষার মুখােমুখি হয়ে গেলেন। দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে একে একে হারাতে লাগলেন ধনসম্পদ, জমিজমা সবকিছু। এমনকি, নিজের ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন সকলে তার এই দুরবস্থা দেখে তার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। তাকে ছেড়ে যায়নি কেবল তার পুণ্যবতী স্ত্রী।[১] চিন্তা করুন, আপনার ভীষণ বিপদের সময়ে, ঘােরতর সংকটে আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলাে যদি আপনাকে ছেড়ে চলে যায়, কেমন লাগবে আপনার? এজন্যেই দুনিয়ার সম্পর্কগুলােতে এমনভাবে জড়াতে নেই যা আখিরাতকে ভুলিয়ে দেয়। দুনিয়াবি সম্পর্কের মােহে যদি আপনি আখিরাতকে কম গুরুত্ব দেন, তাহলে আপনার বিপদের দিন যখন এই সম্পর্কগুলাে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাবে, তখন কিন্তু দুনিয়াটাই আপনার কাছে বিস্বাদ লাগবে। আত্মহত্যা করতে মন চাইবে।

এ রকম পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তাকে। নুহ আলাইহিস সালামের ওপরে তার কওমের অত্যাচার এবং অবাধ্যতার মাত্রা এতই ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল যে, তাদের হাত থেকে নুহ আলাইহিস সালামকে বাঁচানাের জন্যে পুরাে কওমকেই আল্লাহ তাআলা বন্যার পানিতে তলিয়ে দিয়েছিলেন।

ইউসুফ আলাইহিস সালামের জীবনের দিকেই তাকান। খুব ছােটবেলায় ভাইয়েরা শত্রুতা করে তাকে কূপে নিক্ষেপ করে। এরপর মিশরের রাজার কাছে গিয়েও বারে বারে পরীক্ষার মুখােমুখি হয়েছেন। কারাগারে পর্যন্ত নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন।

শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে ঈসা আলাইহিস সালামকে তাে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আসমানেই তুলে নিয়েছেন। আর সর্বশেষ নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহর কতই-না উত্তম বান্দা আর রাসুল ছিলেন তিনি! জন্মের ঠিক আগেই বাবাকে হারিয়েছেন। দুনিয়াকে বুঝতে শেখার আগে হারিয়েছেন গর্ভধারিণী মাকে। যে প্রিয়তম চাচার কাছে আশ্রয় পেয়েছিলেন, একসময় তিনিও একা করে চলে যান। চোখের সামনে সন্তানদের মৃত্যু, প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যু—জীবনের চিত্রনাট্যে হারাবার আর বাকি থাকলই-বা কী? দ্বীনের দাওয়াত শুরু করার পরে তায়েফবাসীর নির্লজ্জ আঘাত, নিজ কওম দ্বারা দেশছাড়া-সহ এহেন অত্যাচার নেই যা তার ওপরে আরােপ করা হয়নি।

[1] তাফসির ইবনু আবি হাতিম : ১৪৫৬২; ফাতহুল বারি, খণ্ড : ৬; পৃষ্ঠা : ৪২১; সহিহ ইবনু হিব্বান : ২৮৯৮; সিলসিলাতুল আহাদি সিস সহিহাহ : ১৭

এই যে নবি-রাসুলদের জীবনে আরােপিত সমস্যা, নেমে আসা বিপদ, নিপতিত হওয়া সংকট—এসব কেন ছিল? তারা তাে নিষ্পাপ ছিলেন। কোনাে পাপ, কোনাে অন্যায় তাদের স্পর্শ করতে পারত না। তারপরও কেন তাদের জীবন ছিল দুর্ভোগময়? কেন তাদের মুখােমুখি হতে হয়েছে সবচেয়ে কঠিন সব পরীক্ষার এগুলাে এজন্যেই যে আল্লাহ তাদেরও পরীক্ষা করেছেন। বিপদের মুখে, সংকটের সামনে তারা আল্লাহর ওপর কতখানি ভরসা করেন তা-ই ছিল দেখার বিষয়।

আমাদের শেখানাের জন্যই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নবি-রাসুলদের জীবন থেকে এই ঘটনাগুলাে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। কঠিন, দুর্ভোগ-দুর্যোগ আর সংকটের সময়ে তারা আল্লাহকে কীভাবে আঁকড়ে ধরে ছিলেন, সেই শিক্ষা দেওয়ার জন্যেই কুরআনুল কারিমে এই ঘটনাগুলােকে তিনি স্থান দিয়েছেন।

আমাদের জীবনেও এ রকম নানান পরীক্ষা নেমে আসতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায়। ভিন্ন ভিন্ন রূপে। জীবনের এ রকম মুহূর্তগুলােকে আল্লাহর পরীক্ষা হিশেবে বরণ করে নেওয়াই হলাে একজন প্রকৃত মুমিনের কাজ।

[ঘ]

আমরা জেনে গেছি কেন আমাদের জীবনে দুর্যোগ নেমে আসে। কেন চারশ থেকে বিপদ আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে। কেন হুট করে আমরা প্রিয়জন, প্রিয়মুখ হারিয়ে ফেলি। কেন হতাশা গ্রাস করে ফেলে আমাদের অন্তর। এই জীবন হলাে পরীক্ষাক্ষেত্র আর আমরা সবাই হলাম পরীক্ষার্থী।

তাহলে জীবন যখন এ রকম দুঃখ আর কষ্টের ভারে নুইয়ে পড়বে, যখন হৃদয় আকাশে ভর করবে কালবােশেখির ঘনকালাে মেঘ, যখন হতাশার অন্ধকারে ডুবে যাবে আমাদের তনুমন, তখন আমাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে?

আপনার যখন বড় কোনাে রােগ হবে, চারপাশ থেকে যখন কেবল হতাশা আর নিরাশার বাণী শুনতে পাবেন, যখন শূন্যতা ভর করবে আপনার দেহমনে, তখন আইয়ুব আলাইহিস সালামের ঘটনা মনে করবেন। মরণব্যাধি শরীর নিয়েও আল্লাহর স্মরণ থেকে তিনি এক মুহূর্তের জন্য গাফিল হননি। যখন আত্মার আত্মীয়রাও তাকে ছেড়ে চলে গেল, তিনি হতাশ হননি। এমন মুহূর্তে তিনি কেবল আল্লাহর কাছেই সাহায্য চেয়েছেন। বলেছেন-

أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ

হে আমার প্রতিপালক, দুঃখক্লেশ আমাকে স্পর্শ করেছে। আপনি তাে দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু।1]

খেয়াল করুন, আইয়ুব আলাইহিস সালামের কথার মধ্যে কিন্তু কোনাে অভিযােগ নেই, অনুযােগ নেই। নেই কোনাে আত্মম্ভরিতা। কেবল আছে বিনয় আর ভরসার অনন্য সমন্বয়। তিনি বলেননি, হে আল্লাহ, আমি কষ্ট পাচ্ছি। আমার কষ্ট কমিয়ে দিন। তিনি বলতে পারতেন, ‘মাবুদ! রােগের কারণে আমি দ্বীনের দাওয়াত দিতে পারছি না। আমাকে আপনি আরােগ্য দিন। তিনি এ রকম বলেননি। তিনি কেবল আল্লাহর সেই গুণের দ্বারা তাঁর প্রশংসা করেছেন, যে গুণের উল্লেখ কুরআনের একেবারে প্রথম সুরাতেই আমরা দেখতে পাই। আইয়ুব আলাইহিস সালাম বলেছেন, আপনি তাে দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু। আল্লাহর সিফাত তথা গুণের মধ্যে অন্যতম গুণ হলাে—আল্লাহ হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু। তার চাইতে বড় দয়ালু আসমান-জমিনে আর কেউ নেই। সুরা ফাতিহার শুরুতেই আমরা এই ঘােষণা দিয়ে থাকি। আমরা বলি, ‘আর রাহমানির রাহিম' অর্থাৎ যিনি হলেন পরম করুণাময় আর অসীম দয়ালু।

আইয়ুব আলাইহিস সালাম অভিযােগ না করে বরং আবদার করেছেন। একজন দাস তার মালিকের কাছে যে সুরে আবদার করে, যে সুরে অনুনয়-বিনয় করে, নবি আইয়ুব আলাইহিস সালামও ঠিক একইভাবে তার মালিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে আবদার করেছেন। সে আবদারে ভালােবাসা ছিল, ভরসা ছিল। নির্ভরতা ছিল।

আইয়ুব আলাইহিস সালামের এই আকুল ফরিয়াদের পরে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তার দুআ কবুল করে নিলেন। তার দুঃখ মুছে দিলেন। রােগ সারিয়ে দিলেন। আল্লাহ বললেন-

فَاسْتَجَبْنَا لَهُ فَكَشَفْنَا مَا بِهِ

অতঃপর, আমি তার আহ্বানে সাড়া দিলাম এবং তার সব দুঃখকষ্ট দূর করে দিলাম।[2]

[1]সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৮৩
[2]সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৮৪

যে আল্লাহ আইয়ুব আলাইহিস সালামকে আরােগ্য দিয়েছেন, তিনি কি আপনাকেও আরােগ্য দিতে পারেন না? অবশ্যই পারেন। কেবল আপনার অন্তরটাকে আইয়ুব আলাইহিস সালামের অন্তরের মতন পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করুন। আপনার অন্তরে আল্লাহর প্রতি ওই নির্ভরতা রাখুন, যে নির্ভরতা আইয়ুব আলাইহিস সালামের অন্তরে ছিল। এরপর আল্লাহর কাছে আকুল ফরিয়াদ করুন। মন খুলে আপনার কথা আপনার রবকে শােনান।

বড় কোনাে বিপদে পড়ে গেলে একদম হতাশ হবেন না। ভেঙে পড়বেন না। আপনার ওপর আরােপিত বিপদ নিশ্চয়ই ইউনুস আলাইহিস সালামের বিপদের চেয়ে গুরুতর নয়। স্মরণ করুন ইউনুস আলাইহিস সালামের কথা। সমুদ্রের মাছ যখন তাকে গিলে ফেলল, কেমন সংকটাপন্ন ছিল সেই মুহূর্তগুলাে? চারদিকে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। একটা ড্রমের ভেতরে চাপা পড়লেই যেখানে আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসবে, সেখানে একটা মাছের পেটে তিনি বেঁচে থাকলেন কীভাবে? কে তাকে বাঁচিয়ে রাখলেন? আল্লাহ ছাড়া কার ক্ষমতা আছে মাছের পেটে নবি ইউনুস আলাইহিস সালামের জন্য অক্সিজেন পাঠাবে?

আপনি কি জানেন এ রকম বিপদে পড়ে নবি ইউনুস আলাইহিস সালাম কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন? তিনি কি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন? ভেঙে পড়েছিলেন? নিশ্চিত মৃত্যু জেনে হাত-পা গুটিয়ে বসে ছিলেন? তিনি কি আল্লাহকে বলেছেন, আল্লাহ, আমাকে তাে নবি হিশেবে পাঠিয়েছেন আপনি। আমি তাে আপনারই কাজ করি। তাহলে আমার ওপরে কেন এই বিপদ নেমে এলাে? কেন এত কঠিন শাস্তি আমার জন্য?

নাহ। তার প্রতিক্রিয়া এ রকম ছিল না। মাছের পেটে বন্দি হওয়ার পরেও তিনি এক মুহূর্তের জন্য আল্লাহর ওপর থেকে ভরসা হারাননি। ভেঙে পড়েননি। আশা ছেড়ে দেননি। তিনি খুব সুন্দর পন্থায় আল্লাহর ওপর ভরসা করেছিলেন। মাছের পেটে বন্দি হওয়ার পরে তিনি যে দুআটি পড়েছিলেন, সেটাকে আল্লাহ তাআলা কুরআনে স্থান দিয়েছেন। সেই দুআ কমবেশি আমরা সকলেই জানি।

لا إله إلا أنت سبحانك إني كنت من الظالمين

লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনায-যালিমীন। বেশ অদ্ভুত রকম সুন্দর এই দুআটি! সাধারণত বিপদে পড়লে আমরা খুব ঘাবড়ে যাই, নার্ভাস হয়ে পড়ি। হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়ি। অথচ ইউনুস আলাইহিস সালামের বিপদের তুলনায় আমাদের বিপদ তাে কিছুই না। সমুদ্রের রাক্ষস মাছের পেটের ভেতরে চলে যাওয়ার মতন সংকট পৃথিবীতে আর কী হতে পারে? এমন অবস্থায় পতিত হয়েও আল্লাহর নবি ইউনুস আলাইহিস সালাম যে ধৈর্য আর ঈমানের প্রমাণ দিয়েছেন তা অবিশ্বাস্য!

এ রকম ঘঘারতর বিপদের সময়েও তিনি একত্ববাদের আহ্বান ভুলে যাননি। তিনি বলেছেন, “লা ইলাহা ইল্লা আনতা’—আপনি ছাড়া কোনাে সত্য উপাস্য নেই।

কঠিন বিপদ। চারদিকে ঘনকালাে অন্ধকার। কোথাও আলাের লেশমাত্র নেই। এমন অবস্থাতেও তিনি বললেন, ‘ওগাে মাবুদ! তুমি ছাড়া আর কোনাে উপাস্য নেই, যে আমাকে এই বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে। কারও ক্ষমতা নেই আমাকে এখান থেকে বাঁচিয়ে নেওয়ার।

দুআর মধ্যে এই কথাটা বলে শুরুতেই তিনি ঈমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতিটাই প্রদান করেছেন। জগতের সকল অসত্য মাবুদ, অসত্য ইলাহর কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করে তিনি এক সত্য ইলাহ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন।

এই ঘােষণার পরে তিনি বলেছেন, সুবহানাকা। অর্থাৎ আপনি পবিত্র।

কী চমৎকার কথা! নিকষকালাে অন্ধকারের মধ্যে নিজের হাত নিজে দেখতে পাচ্ছেন না। মৃত্যু একেবারে সন্নিকটে। এমন অবস্থাতেও তিনি আল্লাহর গুণগান গেয়ে বলছেন, “হে আমার রব! আপনি তাে পবিত্র।

কোনাে বিপদে পড়লে আমরা তাে ফরয সালাতটুকু পর্যন্ত কাযা করে ফেলি। আল্লাহর গুণগান গাওয়া তাে দূরের কথা। কিন্তু দেখুন, এমন ঘােরতর বিপদেও নবি ইউনুস আলাইহিস সালাম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার প্রশংসা, তাঁর স্তুতি, তাঁর যিকির করতে ভােলেননি।

এর পরের অংশে আল্লাহর নবি ইউনুস আলাইহিস সালাম বলেছেন, ইন্নি কুন্তু মিনায-যালিমীন। অর্থাৎ নিশ্চয় আমি ছিলাম জালিম।

বিপদে পড়লে আমরা সাধারণত হাঁ-হুতাশ করি। বিলাপ করি আর বলি, কী এমন অপরাধ করেছি যে, আল্লাহ আমার সাথে এমনটা করছেন? কেন আমাকে এভাবে facuzal? Why always me? Why?'

অথচ, আল্লাহর নবি ইউনুস আলাইহিস সালামের সে রকম কোনাে অভিযােগ, অনুযােগ বা আপত্তি ছিল না। তিনি অভিযােগের সুরে বলেননি, ‘ওগাে আল্লাহ। কেন আপনি আমাকে এ রকম কঠিন বিপদে নিপতিত করলেন? কী ছিল আমার অপরাধ?' বরং তিনি বলেছেন, “হে আমার প্রতিপালক, আপনি হলেন পবিত্র! আর আমি হলাম জালিম। আমিই অন্যায় করেছি। সব দোষ আমার।'[1]

তিনি দোষ স্বীকার করলেন। নিজের অন্যায় মাথা পেতে নিলেন। তবে তার আগে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাকে সকল দোষ, সকল ত্রুটি আর সকল ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে ঘােষণা করলেন। প্রতিউত্তরে আল্লাহ বললেন—

فَاسْتَجَبْنَا لَهُ وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذَلِكَ نُنجِي الْمُؤْمِنِينَ

অতঃপর আমি তার সেই আহ্বানে সাড়া দিলাম এবং তাকে দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলাম। এভাবেই আমি মুমিনদের রক্ষা করি2]

বিপদে পড়লে আমাদের উচিত ধৈর্যধারণ করা। আল্লাহর প্রতি অভিযােগ না এনে নিজের ভুল স্বীকার করা। এরপর সর্বোত্তম উপায়ে আল্লাহর কাছে দুআ করা।

কুরআনে নবি-রাসুলদের এ রকম আরও বেশ কিছু দুআ আছে যেখানে তাদের সর্বোচ্চ ধৈর্য, তাকওয়া আর ঈমানের প্রমাণ পাওয়া যায়। বিপদের সময় তারা কখনাে ভেঙে পড়তেন না। নিরাশ হতেন না। জীবনে বিপদ আপদের সম্মুখীন হলে আমাদেরও উচিত ভেঙে না পড়া। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা। বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করা। কেবল তাঁর কাছেই সাহায্য চাওয়া। বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ অবশ্যই আমাদের দুআ শােনেন এবং তিনি অবশ্যই আমাদের রক্ষা করবেন।

[1] ধারণাটি শাইখ উমার সুলাইমানের In the darkest night লেকচার থেকে পাওয়া।
[2]সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৮৮