-->

বেলা ফুরাবার আগে - বেলা ফুরাবার আগে (পর্ব - ৯)

বেলা ফুরাবার আগে আরিফ আজাদ, বেলা ফুরাবার আগে online reading, আরিফ আজাদের বই, চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়, চোখের রোগ, জীবনের ইঁদুর দৌড় কাহিনি, বেলা ফ
[ ক ]

কিরজেইডা রড্রিগেজ। পৃথিবীর বিখ্যাত একজন ফ্যাশন ডিজাইনার, ফ্যাশন ব্লগার এবং সেলিব্রিটি লেখকের নাম। অর্থ-কড়ি, বিত্ত-বৈভব কিংবা যশ-খ্যাতি- একজীবনে ‘অপ্রাপ্তি’ বলে সম্ভবত কোনাে কিছুই নেই তার ঝুলিতে। দুনিয়াকে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলা রড্রিগেজ খুব সম্প্রতি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর আগে বলে যান কিছু শেষ অনুভূতি। সেই অনুভূতিতে উঠে আসে কিছু টলটলে সত্য। এমন অকপট স্বীকারােক্তি রঙিন কর্পোরেট দুনিয়া আমাদের কখনােই জানাবে না। রড্রিগেজ লিখেছেন-

পৃথিবীর দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি পড়ে আছে আমার গ্যারেজে। কিন্তু কী আশ্চর্য, সেই গাড়িতে আমি আর চড়তে পারছি না! নিত্যনতুন দামি সব ডিজাইনের কাপড়ে আমার ড্রয়ার ভরতি। কিন্তু আজ সেগুলাে আর আমার গায়ে তােলা সম্ভব নয়। আমার সংগ্রহে থাকে পৃথিবীর দামি ব্র্যান্ডের জুতাে। সবচেয়ে দামি ব্যাগটাই থাকে আমার দখলে। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, আজ সেগুলাে নিতান্তই অকেজো আমার ঘরে! টাকায় ভরতি আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, অথচ সেই টাকা আজ আর কোনাে কাজেই লাগছে না। আমার অত্যাধুনিক বাড়িটা দামি দামি সব আসবাবপত্রে ভরপুর, কিন্তু সেই আসবাবে শুয়ে আমি যে একটু আরাম করব, সেই সুযােগ আর । কই? হাসপাতালের ছােট্ট বিছানায় আজ আমি কাতর। অথচ এমনও সময় ছিলাে, পৃথিবীর যেকোনাে প্রান্তে যেতে মন চাইলে আমি আমার ব্যক্তিগত প্লেনে চেপে। দিব্যি চলে যেতে পারতাম! আমার জীবনে কোনাে কিছুরই অভাব নেই। কিন্তু। আমার হৃদয়জুড়ে অভাবের হাহাকার। আমার সবকিছুই আছে, কিন্তু সব থেকেও আজ আমি কেমন যেন নিঃসৃ!

অর্থকড়ি উপার্জনের জন্য যে মানুষটা নিজের গােটা জীবনটাই ব্যয় করল, জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে সেই টাকা, সেই অর্থ তার কোনাে কাজেই আর লাগছিল না। সবচেয়ে দামি পােশাক গায়ে দিয়ে যে মানুষ চষে বেড়াত পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, সময়ের পরিক্রমায় হাসপাতালের দেওয়া রঙিন একটা চাদর ব্যতীত আর কোনাে কিছুই সে গায়ে তুলতে পারছে না! দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি কিংবা ওড়ার জন্য আধুনিক মানের জেট না হলে যার চলতই না, সে কিনা বন্দি হয়ে পড়ে হুইল চেয়ারের শিকলে! জীবন কতটা প্রবঞনাময়, কতটাই ঠুনকো, তাই না? জীবন আসলে একটা মরীচিকার নাম যেখানে মৃত্যুই হলাে ধ্রুব সত্য। দুনিয়ার জীবন বিশাল একটা নাট্যমঞ্চের ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, এই দুনিয়ার উপমা হলাে এমন এক মুসাফিরের মতাে, যে তার ভ্রমণে বের হয়েছে। পথিমধ্যে ক্লান্ত লাগছিল বলে সে একটা গাছের ছায়ায় একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার পথচলা আরম্ভ করেছে। [1]

পথিকের দীর্ঘ সফরটা কিন্তু দুনিয়ার জীবন নয়। সেই সময়টা আরও বহু মাত্রায় প্রলম্বিত। কেবল গাছের ছায়ার নিচে সে যে সময়টুকু ব্যয় করেছে, ওইটুকুই হলাে দুনিয়ার জীবন! মানে, একটা সুদীর্ঘ সময়ের যাত্রায় কেবল খুব অল্প কিছু সময়ের বিশ্রামের নামই হলাে দুনিয়া।

মানুষের জীবনে মৃত্যুর মতন নির্মম সত্য আর কিছু নেই। অথচ সেই নির্মম সত্যকে, সেই অখণ্ডনীয় বাস্তবতাকে অস্বীকার করার জন্য আমাদের কত তােড়জোড়। আমরা মৃত্যু থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাই। কিন্তু পালাতে গিয়ে আমরা মৃত্যুর আরও সন্নিকটে চলে আসি। মৃত্যু আসলে আমাদের তাড়া করে না। মৃত্যু তার নির্ধারিত থানে অপেক্ষারত। সময়ের পরিক্রমায় আমরাই বরং মৃত্যুর দিকে ছুটে যাই নিরন্তর।

ধুকপুক ধুকপুক শব্দে বেজে চলছে আমার হৃৎপিণ্ড। এই কথার অর্থ দুটো। প্রথমত, আমি এখনাে জীবিত আছি, আর দ্বিতীয়ত, আমি একদিন অবশ্যই মারা যাব। বিজ্ঞানের তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রে আমরা পড়েছি, গরম একটি কফির কাপকে টেবিলের। ওপর রাখা হলে সময়ের ব্যবধানে সেটি আস্তে আস্তে ঠান্ডা হতে থাকবে। তবে সেটি কখনােই আরও বেশি গরম হয়ে উঠবে না। তাপগতিবিদ্যার এই সূত্র মানুষের জীবনের সাথেও অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। মাতৃগর্ভে যেদিন আমাদের প্রাণকণা সঞ্চারিত হয়েছিল, ঠিক সেদিন থেকেই আমাদের জীবনের উন্নতার শুরু। এরপর ধীরে ধীরে সেই উন্নতা আমরা হারিয়ে চলেছি। প্রতিদিন হারাচ্ছি। প্রতিনিয়ত হারাচ্ছি। হঠাৎ এমন একটা সময় আমাদের সামনে উপস্থিত হবে, যখন আমরা সমস্ত উয়তা হারিয়ে স্তন্ধ, ঠান্ডা, শীতল হয়ে যাব। সেদিন ছিন্নভিন্ন হবে আমাদের জাগতিক সকল বন্ধন। এর নামই মৃত্যু!

সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনু সালাবাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘তুমি দুনিয়ার জীবন নিয়ে মত্ত, অথচ, হতে পারে তােমার কাফনের কাপড় ইতােমধ্যে ধােপার কাছে চলে এসেছে!’[1]

ভয়ংকর সত্য কথা! এই যে আজ আমি দুনিয়ার স্রোতে গা ভাসিয়ে চলছি, আখিরাতের চিন্তা হৃদয়-মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি, আমি কি নিশ্চিত যে আগামীকালকের রাঙা প্রভাতে আমি দুচোখ মেলতে পারব? আজকেই যে আমার জীবনের শেষ দিন নয়, জীবনের শেষ সকালটা যে ইতােমধ্যে আমি পার করে ফেলিনি, তার কী নিশ্চয়তা? আজ যদি আমার মৃত্যু হয়, তাহলে আমার কাফনের কাপড় তাে ইতােমধ্যে বাজারে চলে এসেছে। অপেক্ষা কেবল একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তের। যে মুহূর্তে দোকানদারের কাছে আমার মৃত্যুসংবাদ পৌঁছাবে আর তিনি সাড়ে তিন হাত কাপড় কেটে নিয়ে আমার শেষ বিদায়ের জন্য প্যাকেট করে দেবেন।

যদি আজ সত্যিই আমার মৃত্যু হয়, আমি কি তাহলে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানাের জন্য প্রস্তুত? মৃত্যুর আগে শেষ ওয়াক্তের সালাতে আমি কি হাজির ছিলাম? যেদিন আমার মৃত্যু হয়, সেদিন আমার ঘরের টেলিভিশন কতবার অন-অফ হয়েছে আর কুরআন কতবার খােলা-বাঁধা হয়েছে? মৃত্যুর আগের সময়টাতে কতবার আমার ঠোঁটে আল্লাহর যিকির গুঞ্জরিত হয়েছে আর কতবার অহেতুক আলাপে মৌজ-মাস্তি করে আমি সময় কাটিয়েছি?

[ খ ]

দুনিয়ার জীবন নিয়ে সুগভীর একটি উপলদ্ধি আছে ইমাম গাজালি রাহিমাহুল্লাহর। তিনি বলেছেন, একজন লােক জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে একটা সিংহ তাকে ধাওয়া করতে শুরু করে। সিংহের থাবা থেকে বাঁচতে লােকটা প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল। লােকটা দেখল, কাছেই একটা কূপ। সে ভাবল, এই কূপে ঝাঁপ দিলে সিংহের আক্রমণ থেকে হয়তাে বাঁচা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। লােকটা সিংহের ভয়াল থাবা থেকে বাঁচতে ওই কূপের মধ্যেই ঝাঁপ দিল। কূপে ঝাঁপ দিয়ে লােকটা কোনােভাবে একটা দড়ি আঁকড়ে ধরতে সক্ষম হলাে। ফলে, সে একেবারে কূপের গভীরেও গিয়ে পড়ল না। লােকটা ভাবল, যাক বাবা, এই যাত্রায় অন্তত বাঁচা গেল! কিন্তু পরক্ষণেই কূপের নিচে দৃষ্টি পড়ার সাথে সাথেই লােকটা একেবারে চমকে উঠল। দেখল, কূপের নিচে বিশাল আকৃতির একটি বিষধর সাপ হাঁ করে আছে তাকে গিলে খাওয়ার জন্য। এবার লােকটা ওপরে তাকাল। দেখল, কূপের মুখে অপেক্ষমাণ আছে সেই ভয়ংকর সিংহ।

একটু পরে কোত্থেকে যেন একটা সাদা ইঁদুর আর একটা কালাে ইঁদুর এসে লােকটার জড়িয়ে ধরা দড়িটা কুটকুট করে কাটতে শুরু করেছে। অবস্থা তাে খুবই ভয়ানক! ওপরে সিংহ, নিচে সাপ। মাঝখানে এই ইদুরদের চরম শত্রুতা। মৃত্যুকে ঠেকানাের কোনাে উপায়ই আর অবশিষ্ট নেই।

হঠাৎ লােকটার সামনে কোত্থেকে একটা মধুর চাক আবির্ভূত হলাে। সেই চাক থেকে চুইয়ে চুইয়ে মধু পড়ছে। লােকটা এক হাতে সেই মধু নিয়ে মুখে পুরে দিল। মধুর স্বাদ আর মিষ্টতা লােকটাকে ওপরের সিংহ, নিচের সাপ আর সেই দুই শত্রু ইদুরের কথা একদম ভুলিয়ে দিল।

গল্পটি বলার পরে ইমাম গাজালি রাহিমাহুল্লাহ মন্তব্য করেছেন, ‘সিংহটা হলাে মৃত্যু যা নিয়তই আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সাপটা হলাে কবর যার মধ্যে সকল বনি আদমকে যেতে হবে। দড়িটা হলাে মানুষের জীবন। সাদা ইঁদুর আর কালাে ইঁদুর হলাে দিন এবং রাত যা প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনটাকে সংক্ষিপ্ত করে দিচ্ছে। আর মধুটা হলাে দুনিয়া। দুনিয়ার মােহ, মিষ্টতা আমাদের মৃত্যু (সিংহ), কবর (সাপ) এবং সেই দিনের কথা ভুলিয়ে দেয় যেদিন আমরা সকলে আল্লাহর সামনে পুনরুত্থিত হব।

কত অর্থবহুল ভাবনা, দেখুন! মৃত্যু একটা সিংহের মতন। একটা ভয়ংকর, ভয়ার্ত বাস্তবতা। মৃত্যু নামক সেই সিংহের থাবা থেকে আমার-আপনার কারােরই নিস্তার নই। কবর হলাে সাপের সেই হাঁ করা মুখ আর দড়িটা হলাে আমাদের জীবন। সা আর কালাে ইদুর হলাে দিন আর রাত। একটি করে দিন আর রাত পার হচ্ছে। মানে জীবনের সেই দড়ির কিছু অংশ ক্ষয়ে যাচ্ছে। ছিড়ে যাচ্ছে। হাসান আল বাসরি। রাহিমাহুল্লাহ বলতেন, “মানুষ হচ্ছে সময়ের সমষ্টি। জীবন থেকে একটি দিন গত হওয়া মানে মানুষের একটা অংশ গত হয়ে যাওয়া। [1]

এভাবে যেদিন সেই ইঁদুরেরা সম্পূর্ণ দড়িটাকে কেটে ফেলবে, ছিড়ে ফেলবে, সেদিন আমরা নিক্ষিপ্ত হব সাপের পেটে। অন্ধকার কবরে। কিন্তু এতসব বাস্তবতা রেখে, দুনিয়ার মােহের পেছনে আমরা ছুটে বেড়াই নিরন্তর। আমরা ভুলে যাই আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যের কথা। আমরা বিস্মৃত হই সেই জীবনের ব্যাপারে, যে জীবনটাই সত্য, অমােঘ।

[ গ ]

সময়ের সাথে সাথে ফুরিয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবন। অন্তিম মুহূর্তটা আস্তে আস্তে কাছে চলে আসছে। মৃত্যু যে অমােঘ, অবধারিত, এ ব্যাপারে আমাদের মনে কোনাে সন্দেহ নেই। কুরআন দ্ব্যর্থ কণ্ঠে ঘােষণা করেছে—

كُلُّ نَفْسٍ ذَآئِقَةُ الْمَوْتِ

নিশ্চয় সকল প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।[২]

একদিন আমরা নিশ্চিতভাবে মারা যাব, ছেড়ে যাব এই রঙিন দুনিয়া। ছেড়ে যাব আমাদের সকল আত্মীয়তার বন্ধন। সমস্ত কিছু জেনেও আমরা কি মৃত্যুর জন্য পাথেয় সংগ্রহ করি? কোনাে নাবিক কি জাহাজবিহীন সমুদ্রযাত্রা করে? কোনাে যাযাবর খাদ্যপানীয়বিহীন মরুভূমির পথে রওনা করে কখনাে? নাবিক খুব ভালাে করেই জানে, জাহাজ ছাড়া সমুদ্রযাত্রায় তার ধ্বংস অনিবার্য। যাযাবর জানে খাদ্যপানীয় ছাড়া মরুভূমিতে তার মৃত্যু সুনিশ্চিত। অবশ্যম্ভাবী ফলাফল জেনেই তারা প্রয়ােজনীয় রসদ সংগ্রহ করে নিজ নিজ যাত্রায় পাড়ি জমায়। কিন্তু আমাদের সামনে যে অনন্ত যাত্রা, যে অসীম সময়-সমুদ্রে আমাদের অবগাহন, সেই যাত্রার।

জন্য কি আমরা কোনাে রসদ মজুদ করি? সময়ের শেষ ঘণ্টা বেজে ওঠার আগেই। কি আমাদের উচিত নয় যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে নেওয়া?

অতিশয় সত্য কথা হলাে এই—মৃত্যুর ব্যাপারে আমরা চূড়ান্তরূপে উদাসীন। অথচ আমাদের সােনালি প্রজন্মের সােনার মানুষগুলাে মৃত্যুকেই জীবনের লক্ষ্য বানাতেন। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করাই ছিল তাদের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাপড়ের একটা অংশ ধরে বলেছেন, পৃথিবীতে আগন্তুকের ন্যায় জীবনযাপন করাে [১]

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবনু উমারকে আগন্তুকের ন্যায় বাঁচতে বলেছেন। আগন্তুকের মতাে থাকা মানে হলাে নিজেকে এই দুনিয়ায় থিতু মনে না করা। এমন ভাবা যে, এই দুনিয়াই আমার সব। আমি কখনােই এই দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হব না; বরং দুনিয়ায় আমাদের থাকতে হবে আগন্তুকের মতাে। এমনভাবে, যেন আমরা এখানে মুসাফির। এক সুদীর্ঘ সফরের মাঝে দুনিয়ার জীবন খুব অল্প কিছু সময় মাত্র!

দুনিয়ার জীবনে কীভাবে বাঁচতে হবে, সে ব্যাপারে আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, “যখন সন্ধ্যা উপনীত হয়, তখন সকালের জন্য অপেক্ষা করাে না। আর সকাল উপনীত হলে সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষায় থেকো না। তােমার সুস্থতা থেকে কিছু সময় তােমার অসুস্থতার জন্য বরাদ্দ রাখাে এবং সময় থাকতে মৃত্যুর জন্য পাথেয় সংগ্রহ করে নাও।[২]

সন্ধ্যায় জীবিত আছে এমন লােক যে পরের দিন সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকবে, সেই নিশ্চয়তা নেই। আবার সকালে জীবিত আছে এমন লােক যে সন্ধ্যা অবধি বেঁচে থাকবে, সেটাও অনিশ্চিত। আমাদের জীবন এতটাই ঠুনকো, ভঙ্গর এবং অনিশ্চয়তায় ভরা।

আমাদের জন্মের ক্রমধারা আছে, কিন্তু মৃত্যুর কোনাে ক্রমধারা নেই। মৃত্যু কোনাে ক্রমধারায় বিশ্বাস করে না। আমার পিতা আমার আগে জন্মেছেন। তার আগে কখনােই আমি দুনিয়ায় আসতে পারি না। তবে, আমি যে আমার পিতার পরে মারা যাবাে, সেই নিশ্চয়তাটুকু কেউ দিতে পারে না। মৃত্যুর ক্রমধারা নেই জেনেও, আমরা কি আমাদের কৃত পাপ কাজ হতে নিবৃত্ত হতে পেরেছি? যে-কোনাে মুহূর্তে, যে-কোনাে। অবস্থায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে'—এই অমােঘ সত্য বুঝতে পেরেও আমরা। কি আমাদের পরকালের পাথেয় সংগ্রহের ব্যাপারে আদৌ তৎপর? অথচ আমাদের। সােনালি প্রজন্মের মানুষগুলাে আল্লাহর ক্ষমালাভের জন্য কতটাই-না ব্যাকুল ছিলেন! ভুলে যদি পাপ হয়ে যেত, তাওবা করতে তারা এক মুহুর্ত দেরি করতেন না। পাপের। ওপর অটল থাকতেন না এবং পাপকে লুকিয়ে লুকিয়ে বৃদ্ধি করতেন না। এমনকি পাপ থেকে পবিত্র হতে তারা মৃত্যুকেও বরণ করে নিয়েছিলেন হাসিমুখে।

ইসলামে যিনা তথা ব্যভিচারের শাস্তি হলাে রজম। পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে একবার এক ব্যভিচারিনি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে পবিত্র করুন। আমি যিনা করেছি। যিনার দায়ে আমি এখন গর্ভবতী। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কি সত্যিই গর্ভবতী?' মহিলাটি বলল, “হ্যাঁ। তখন আল্লাহর রাসুল মহিলাটিকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। বললেন, তুমি চলে যাও। তােমার গর্ভের সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তারপর এসাে। মহিলাটি চলে গেল। কয়েক মাস পরে যখন গর্ভের সেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হলাে, তখন সেই মহিলা আবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে পবিত্র করুন। আমার গর্ভের সন্তান জন্মলাভ করেছে। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি চলে যাও। তােমার সন্তান দুধ ছাড়ার বয়সে উপনীত হলে এসাে। মহিলাটি সেবারও চলে গেল। এরপর যখন বাচ্চাটি দুধ ছাড়ার বয়সে পৌঁছাল, তখন সেই মহিলা বাচ্চার হাতে এক টুকরাে রুটি ধরিয়ে দিয়ে পুনরায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলাে এবং ছেলের হাতে ধরে থাকা রুটির টুকরাে দেখিয়ে বলল, “হে আল্লাহর রাসুল, এই দেখুন, আমার ছেলে দুধ ছাড়ার বয়সে উপনীত হয়েছে। আপনি এবার আমায় পবিত্র করুন। তখন মহিলাটিকে রজম অর্থাৎ পাথর মেরে হত্যার আদেশ দেওয়া হলাে। সেদিন খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু একটা পাথর নিক্ষেপ করেন ওই মহিলার গায়ে। সেই পাথরের আঘাতে মহিলার মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত এসে খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহুর গায়ে লেগে যায়। তিনি তখন মহিলাটিকে তিরস্কার করতে শুরু করেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, ‘খালিদ, থামােয় তার ব্যাপারে কোনাে খারাপ মন্তব্য করাে না। আল্লাহর শপথ! সে এমন তাওবা করেছে, এ রকম তাওবা যদি কোনাে বড় জালিমও করে, তাহলে আল্লাহ তাকেও ক্ষমা করে দেবেন।[1]

যিনার মতন গুরুতর পাপের বােঝা থেকে সময় অর্থাৎ হায়াত থাকতেই মুক্ত হতে। কী প্রাণান্তকর চেষ্টা ওই মহিলার! এমনকি বাচ্চার হাতে রুটি ধরিয়ে দিয়ে প্রমাণ করলেন যে, তার বাচ্চা দুধ ছেড়ে দিয়েছে। এটা করার কারণ হলাে, যাতে নবিজি তার কথা বিশ্বাস করেন। তাকে আর ফেরত না পাঠান। নবিজি চাইলে এখনই তার শাস্তি বাস্তবায়ন করতে পারেন। মহিলাটি জানত, সময় থাকতে আল্লাহর ক্ষমালাভ করতে না পারলে তার আখিরাতের অনন্ত জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই পাপের বােঝা থেকে মুক্ত হতে মৃত্যুকেও হাসিমুখে বরণ করে নিতে দ্বিধা করেননি ওই মহিলা। আমরা যারা আজ জীবিত আছি, আমাদের পাপগুলাের ব্যাপারে কখনাে কি আমরা এভাবে ভেবেছি? কখনাে কি নিভৃতে আল্লাহর কাছে অশ্রু ঝরিয়েছি? কখনাে কি রাতের তাহাজ্জুদে দুহাত তুলে বলেছি—‘পরওয়ারদিগার! জীবনটাকে আপনার অবাধ্যতায় ভরে ফেলেছি। জমিনের ওপরে এমন কোনাে পাপের অস্তিত্ব নেই যা আমার দ্বারা হয়নি। আজ লজ্জিত মুখে, অবনত মস্তকে, আকুল চিত্তে আপনার ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। আপনি ব্যতীত আমাদের আর কোনাে ইলাহ নেই। নেই কোনাে আশ্রয়স্থল। আপনিই আমাদের আশা, ভরসা এবং নির্ভরতার প্রথম আর শেষ জায়গা। আপনি যদি ক্ষমা না করেন, তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব। আপনার সীমাহীন দয়ার ভান্ডার থেকে আমার জন্য কিছু দয়া বরাদ্দ করুন।

জীবন হলাে সময়ের সমষ্টি। কোনাে জিনিস হারিয়ে গেলে আমরা ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়ি। আমাদের জীবন থেকে প্রতিদিন একটি করে মূল্যবান দিন হারিয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, জীবন থেকে হারাতে থাকা এই সময়গুলাের জন্য আমরা কি কখনাে ইন্নালিল্লাহ পড়ি? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিদিন একশাে বার তাওবা করতেন।২] আমরা কতবার তাওবা করি প্রতিদিন? অথবা প্রতি সপ্তাহে? কিংবা প্রতি মাসে?

সময় থাকতে তাওবা না করায়, ঈমান না আনায় নবিজির সুমহান সুহৃদ, নবিজির প্রিয়তম চাচা আবু তালিবের স্থান হবে জাহান্নামে। এমনকি তার জন্য নবিজিকে দুআ করার অনুমতিটুকুও দেওয়া হয়নি। ভাবুন তাে, বেলা ফুরাবার আগে যদি আমরা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হই, ক্ষমা না চাই, না শুধরাই—আখিরাতে আমাদের স্থান কোথায় হবে? সময় থাকতে যারা আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে ফিরে আসেনি, যারা। নিজেদের জীবনকে জাহিলিয়াতের ওপরেই সমাপ্ত করেছে, আখিরাতে তারা বারংবার। আফসােস করতে থাকবে। যারা দুনিয়ায় বসে নিজেদের আখিরাত ধ্বংস করে ফেলবে, মৃত্যুর পর তারা বলবে, হায়! আমি যদি মাটি হয়ে যেতাম! [১] দুনিয়ার জীবন নিয়ে মৌজ-মাস্তিতে ব্যস্ত আছি আমরা। ভাবছি, যৌবন তাে উপভােগেরই সময়! জীবন যদি এখন না উপভােগ করি তাে কবে? অথচ আমরা ভুলে যাই, মৃত্যু যৌবন বােঝে । বােঝে না বৃদ্ধাবস্থা কিংবা শৈশব। আখিরাতের পাথেয় সংগ্রহ ব্যতীতই যদি আমাদের পাড়ি জমাতে হয় আখিরাতের পথে, তাহলে সেদিন আফসােস করে বলব, ‘হায়! যদি আমি পরকালের জন্য কিছু করতাম!'[২] নিজেদের পাপে ভরা আমলনামা দেখে সেদিন আমি ভয়ে চমকে উঠব। কারণ, এ যে আমার পাপের খতিয়ান। জীবনের সকল মুহূর্ত, সকল কৃতকর্ম তাতে লিপিবদ্ধ। সেই আমলনামা দেখে আমি বলব, ‘হায়! আজকে আমাকে যদি আমার আমলনামা দেওয়া না হতাে!’[৩]

[ ঘ ]

কেউ যদি বলে যে সে কারও দাসত্ব করে না, তার কোনাে প্রভু নেই, নিয়ন্ত্রক নেই, তাহলে সে মিথ্যা বলেছে। প্রতিটা মানুষ অবশ্যই কারও-না-কারও দাস। হয় সে আল্লাহর দাসত্ব করে, নয়ত সে তার নিজের প্রবৃত্তির দাসত্ব করে। এজন্যেই ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেছিলেন, “হে আদম সন্তান! তুমি যদি এই দুনিয়াকে আখিরাতের বিনিময়ে বিক্রি করাে, তাহলে নিশ্চিত থাকো, তুমি দুনিয়া এবং আখিরাত উভয়ই লাভ করবে। আর যদি তুমি আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়া ক্রয় করাে, তাহলে তুমি দুটোই হারাবে।

ফুযাইল ইবনু ইয়ায রাহিমাহুল্লাহকে বলা হলাে, আপনার কাছে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার কোনটি? তিনি বললেন, আমার কাছে সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে, যখন দেখি একজন মানুষ আল্লাহ সম্পর্কে জানে, তথাপি সে আল্লাহর অবাধ্য হয়।

ভাবুন তাে! ফুযাইল ইবনু ইয়ায কি কথাগুলাে আমাদের জন্য বলেননি? আমরা। আল্লাহ সম্পর্কে ঠিকই জানি। আমরা জানি যে, আমাদের একদিন মৃত্যু হবে। একদিন মুখােমুখি হতে হবে বিচার দিবসের। আমরা কবর, হাশর-মিযান এবং কিয়ামত সম্পর্কেও সম্যক অবহিত। এরপরও আমরা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে নিয়মিত না এরপরও আমরা সুদ নিই, ঘুস খাই, লােক ঠকাই, মিথ্যা কথা বলি। আমরা আল্লাহকে চিনি ঠিকই, কিন্তু মানতে চাই না। এরচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার আর কিছু হতে পারে।

দুনিয়ার সবকিছুর জন্যই আমরা প্রস্তুতি নিই। চাকরির জন্য, ক্যারিয়ার, বিয়ে, এমনকি নিত্য বাজার-সদাই করার জন্যও আমাদের একটা প্রস্তুতি থাকে। কিন্তু আমাদের কেবল প্রস্তুতি নেই মৃত্যুর জন্য। ফরয সালাতের বাইরের সুন্নাত সালাতগুলাে আমরা সময় থাকলেও আদায় করি না। অলসতা করি। অথচ কবরের জগতে এমন কত মানুষ আহাজারি করছে দুনিয়ায় ফিরে এসে একাগ্রচিত্তে আল্লাহকে একটা সিজদা করার জন্য তারা আফসােস করছে কেন তারা দুনিয়ার সময়গুলােকে সঠিকভাবে কাজে লাগায়নি

وَأَنْ أَقِيمُواْ الصَّلاةَ وَاتَّقُوهُ وَهُوَ الَّذِيَ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ

হায়! যদি আমাদের পুনরায় দুনিয়ায় পাঠানাে হতাে, আর আমরা আমাদের রবের নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন না করতাম এবং আমরা হতাম ঈমানদারদের শামিল ১)

আমরা কি জানি আমাদের জীবনের শেষ দিন কোনটি? শেষ অংশ আর শেষ আমল কোনটি হবে? জানি না। আজকের দিনটাও তাে আমার জীবনের শেষ দিন হতে পারে। আজকের অংশটুকুই হতে পারে আমার জীবনের শেষ অংশ। আজকের আমলটুকুই হতে পারে আমার জীবনের শেষ আমল। আজকেই যদি আমার জীবনের শেষ দিন হয়, তাহলে আজকের দিনটিকে আমার জীবনের সেরা দিন বানাতে হলে আমাকে ঠিক কী করতে হবে? আমার আজকের আমলটাই যদি জীবনের শেষ আমল হয়, তাহলে আমার আজকের দিনের আমলগুলাে ঠিক কেমন হতে হবে?

বলা ফুরিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। আসন্ন হচ্ছে আল্লাহর প্রতিশ্রুত সময়। আল্লাহ বলেছেন-

اقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ وَهُمْ فِي غَفْلَةٍ مَّعْرِضُونَ

মানুষের হিশেব-নিকেশের সময় আসন্ন। অথচ তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রেখেছে।[1]

জীবনের বেলা একেবারে ফুরিয়ে যাওয়ার আগে আমাদের জীবনতরীকে নির্বিঘ্নে কূলে ভেড়াতে হবে। সেই কূল, যে কূলে আর কোনাে দুশ্চিন্তা নেই। নেই কোনাে মন খারাপের গল্প।